Friday 1 July 2011

সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন

বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন নিয়ে মিডিয়াতে বিস্তর আলোচনা চলছে। দেশের বরেন্য বুদ্ধিজীবি রাজনীতিবিদরা সংবিধানকে নানা ভাবে জোরা তালি দিয়ে বিভিন্ন চেতনার পক্ষে বিপক্ষে নিয়ে যাওয়ার টানাটানি খেলায় ব্যস্ত। সংসদ ও আদালত নিজ নিজ ক্ষমতা জাহির করে পরস্পর বিরোধী অবস্থান নিয়ে দেশকে এক মহা সাংবিধানিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। সংবিধান সংশোধনী নিয়ে গঠিত সংসদীয় কমেটি নানা মণি ঋষিদের সাথে শলা পরামর্শ করে সংশোধনের একটি চুড়ান্ত প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে এক পাক্ষিক সংসদে তা হয়তো নির্দ্বিধায় পাস হয়ে যাবে। অন্যপক্ষ সেটাকে না মেনে কঠোর কর্মসূচির আন্দোলনে রাজপথ গরম রাখবে। ভোগান্তি বাড়বে জনগনের।  বেচারা জনগন! তিন দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামী-বি এন পি’র  টম অ্যান্ড জেরির তামাশার রাজনীতিতে চেতনা খুঁজতে খুঁজতে চৈতন্য হারাতে বসেছে। সরকারি দল বলে এটা করা যাবে না এটা অসাংবিধানিক, ওটা করা যাবে না ওটা আইনের শাসন পরিপন্থি। অন্যদিকে বিরোধী দল বলবে এটা মানতে হবে এটা জনগনের দাবি ওটা করতে হবে নইলে স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব সব বিপন্ন হবে। এই যে স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি, হানাহানি, প্রতিহিংসা যা আমাদেরকে সামান্য ইস্যুতে বিভক্ত করে ক্রমাগত দূর্বল থেকে দূর্বলতর করছে। দিন দিন ব্যর্থতার অতল গহীনে হারিয়ে যাচ্ছি আমরা। সংবিধান সংশোধন করে কি এই দূর্ভোগ ও দূর্দশা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব?  

সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বউচ্চ দলিল। যাকে মহা প্রবিত্র মহা মূল্যবান বলা হয়ে থাকে। এটি একটি জনগোষ্ঠীর, একটি জাতির চিন্তা-চেতনা-গভীর বিশ্বাসের প্রতিছ্ববি। এই চিন্তা-চেতনা-গভীর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে জাতি তার আগামীর পথে যাত্রা করে। মূল্যায়ন করবে তার আগ্রগতি সাফল্য-ব্যর্থতা। কে সংশোধন করবে এই সংবিধান? কি ভাবে করবে? সংবিধানে জনগনের সত্যিকারের চিন্তা-চেতনা-গভীর বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটাতে কি ধরনের সংশোধন আনতে হবে? এ সব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দেশের শিক্ষিত চিন্তাশীল মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে।
জাতীয় সংসদ ই সংবিধান সংশোধনের একমাত্র এখতিয়ার রাখে” এ কথার সাথে অনেকেই হয়তো সুর মেলাবেন। কেননা জাতীয় সংসদই রাষ্ট্রের সর্বউচ্চ নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মুশকিল হল সংখাগরিষ্ঠাতার জোরে যদি একটি দল তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাসকে জাতির চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস বলে চালিয়ে দেয়, নিজস্ব ভাবাদর্শকে জাতির ভাবাদর্শ বলে চাপিয়ে দেয়। জনগনই বা সেটা মানতে যাবে কেন। নির্বাচনী ইশতেহারে কোন দলই তো সংবিধান সংশোধনের কোন অঙ্গীকার করেনি। জনগন ভোট দিয়েছে বিদ্যমান সংবিধান অনুসারে দেশ শাসনের করার জন্য। প্রয়োজনে সংবিধান অনুয়ায়ী আইন প্রনয়ণ করার জন্য। সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করার জন্য নয়। তাই নীতিগত ভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংসদ রাখে না। যে সংস্থাটি সং বিধানের অধীনস্ত সেই সংস্থা সংবিধানের আকার ও প্রকৃতি ঠিক করবে এ ধরনের যুক্তি সত্যি অর্থহীন ও হাস্যকর।
কিছুদিন আগে চারদলীয় জোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এখন চৌদ্দদলীয় জোট। সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে যদি সংবিধান সংশোধন করার বিঁধান রাখা যায় তা হলে বাংলাদেশের বাস্তবতায় কয়েক বৎসর পর পর সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেননা চলমান ব্যবস্থায় যেহেতু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো জনগনের মৌলিক  চাহিদা পূরণে ব্যর্থ তাই জনগনের আস্থাহীনতার ভোটে একবার এই জোট তো আরেক বার ঐ জোট ক্ষমতার  আসনে বসবে। তাই একটি আওয়ামী আর একটি বি এন পি সংবিধান রাখতে হবে। আওয়ামী আমলে আওয়ামী সংবিধান, বি এন পি আমলে বি এন পি সংবিধান। প্রচলিত ব্যাক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক প্রতিহিংসার রাজনীতির মধ্যে দিয়ে বড় দুটি দলের ঐক্য সূদুর পরাহত তাই তাদের দিয়ে একটি সংশোধিত জাতীয় সংবিধান কেবল ই অলীক স্বপ্ন মাত্র।
অনেকের মতে “আদালত সংবিধানের রক্ষক। জনগনের অধিকার সংরক্ষণের শেষ আশ্রায়স্থল”। তাই  সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব স্বার্থন্বেষী রাজনীতিবিদের না দিয়ে আদালতের উপর ন্যাস্ত করাই শ্রেয়। আমরা তো দেখেছি আদালত কিভাবে সংসদের আনা সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করতে পারে। বর্তমান সংসদ যে সংশোধনী আনতে যাচ্ছে আগামীর কোন এক আদালত যে সেটাকে বাতিল ঘোষণা করবে না তার গ্যারান্টি কি। অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাবেন যে বর্তমান সংসদ তো জনগনের ভোটে নির্বাচিত সংসদ কোন সামরিক সরকারের দপ্তর নয়। তাই এই সংসদ কর্তৃক আনীত সংশোধন কোন আদালত বাতিল করতে পারবে না। কিন্তু সম্প্রতি আদালত কর্তৃক পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করার প্রক্রিয়া যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায় আদালত মুলত দুটি আইনি তত্ত্বের(legal principle) ভিত্তিতে সংশোধনীগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এক অনির্বাচিত সরকার সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা রাখেনা। দুই মৌলিক কাঠামো (basic structure) সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি কোন সংশোধন বৈধ হতে পারে না।
যাই হোক, মোটকথা আদালত সংবিধানের সংরক্ষক বিধায় তারা সংবিধানের কোন মৌলিক পরিবর্তন বরদাস্ত করবে না। জাতীয় সংসদের মত আদালত ও সংবিধানের একটি অধীনস্ত সংস্থা। তাই সংবিধানকে রক্ষা করার ক্ষমতা এর হাতে থাকলেও সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন বা মৌলিক সংশোধনের ক্ষমতা আদালতের নেই। জাতীয় ঐক্য ও অগ্রগতির জন্য এই মৌলিক পরির্তনটা এখন সবচেয় বেশি প্রয়োজন। যেন তেন সংশোধনের কোন মানে হয় না। যে লাউ সেই কদু।
তাছাড়া আমাদের বর্তমান রাষ্টীয় ব্যবস্থায় স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের আশা বলতে গেলে একেবারে ই নেই। যে জোটই ক্ষমতায় আসবে তারাই বিচার বিভাগকে নির্লজ্জের মত নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। যদি আওয়ামী জোট আগামীতে ক্ষমতায় আসতে না পারে তাহলে বি এন পি জোট  সরকারের বিচার বিভাগ আইন শাস্ত্রের কোন এক তত্তের ভিত্তিতে এ সরকারের আনীত সকল সংশোধনী নির্দ্বিধায় বাতিল করবে। আমরা দেশবাোসী অসহায় দর্শকের মত সংবিধানটিকে দেখব টেনিসের বলের মত একবার এ জোটের কোর্টে আরেক বার ঐ জোটের কোর্টে।
আমাদের বর্তমান সংবিধানটি বাহাত্তুরের সংবিধান অর্থাৎ ৭২ সালের গন পরিষদের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদেস্যরা যে চেতনা বা আদর্শের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করেছেন তা থেকে সরে আসার উপায় বর্তমান ব্যবস্থায় নাই। জনগনের ভোটে নির্বাচিত সংসদও পারবে না, আদালত ও পারবে না। আর পারবেই বা কি করে বলুন প্রচলিত ব্যবস্থাটি যে ঐ সংবিধানের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন হল ৭২ রের  সংবিধান প্রণয়ন  কমিটির মতাদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ যখন প্রমাণিত ভাবে দেশের ঐক্য ও অগ্রগতি সাধনে ব্যার্থ এবং এ আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠা রাষ্ট্র ব্যাবস্থাটি যখন জনগনের মৌলিক চাহিদা সমূহ পূরণে অপারগ তখন এ অক্ষম অকার্যকর মতাদর্শের সংবিধান জাতি আর কত কাল বয়ে বেড়াবে? একটি কমিটি সেদিন বাংলাদেশের সাত কোটি মুসলমানের চিন্তা-চেতনা-গভীর বিশ্বাসকে সঠিক ভাবে নিরূপণ না করে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটি মতবাদ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে যে পাপ তারা করেছে তার বোঝা আর কতদিন আমাদের বহন করতে হবে? একটা মরা গাছে পানি না ঢেলে আমরা কি একটি নতুন গাছ লাগাতে পারি না যা আমাদের বুকের মাটি আর ঈমানী আবহাওয়ার সাথে মানান সই। যে সংবিধানের গোড়াতেই গলধ তার আগা ছেটে লাভ কী?
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হয়তো একটি ভাল মতবাদ যারা ধর্মনিরপেক্ষ তাদের জন্য কিন্তু আমরা তো ধর্মিক। ইসলাম ও এর আকীদাকে আমাদের চেতনা থেকে মুছে ফেলবো কি করে? বুকে ঈমান নিয়ে বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া যায় না, সেটা ভণ্ডামী। এরপর ও একটি অনৈসলামিক সংবিধান ও এর রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে যারা ঘষে মেঝে ইসলামিক বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাদেরকে সবিনয়ে বলতে চাই আপনারা কি কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার গল্প শোনেন নি? কাক কখনো সে ডিমকে ফুটতে দেয় না। আর যদি ভাগ্যক্রমে ফুটে একটা কোকিলের ছানা বের হয় কাক তার তীক্ষ্ণ ঠোট দিয়ে ঠোকর মেরে তাকে হত্যা করে অথবা বাসা থেকে বিতাড়িত করে।
আসুন আমরা যারা সচেতন শিক্ষিত, আমরা যারা এ দেশটাকে ভালোবাসি দেশের মানুষদের ভালোবাসি আমরা একটু গভীর ভাবে, গোড়া থেকে চিন্তা করে দেখি কোন মতাদর্শ কোণ ব্যবস্থা দেশের মানুষকে এক সূতার ঐক্যে বাধবে এবং আমাদেরকে সন্মান ও সমৃদ্ধির সঠিক দিকনির্দশনা দেবে।

লেখক:          
ব্যারিষ্টার রেজাউল করিম



 

No comments:

Post a Comment